• হামিদ অাহসান
    • শুক্রবার, ০৯ অক্টোবর ২০১৫, ০৭:১৫ অপরাহ্ন
    • বিষয়ঃ গল্প
    • দেখেছেঃ 1934 বার
    • মন্তব্যঃ 0 টি
    • পছন্দ করছেনঃ 0 জন

গহীনে বাস করে যারা ……………….(গল্প)


উত্তরা এগারো নম্বর সেক্টরের চার নম্বর রোডের তেতাল্লিশ নম্বর বাসা। বাসা খুঁজে পেতে আমাকে বিশেষ বেগ পেতে হল না। আমি ঢাকার দক্ষিণ প্রান্তের মানুষ হলেও এই এলাকায় আমার অনেক আত্মীয়-স্বজন-মামা-খালুরা বসবাস করে। সেই সুবাদে অনেক আসা হয় এখানে। কাজিনদের সাথে এই এলাকায় কত যে আড্ডা-গল্প আর ঘুরাঘুরি করেছি আমি তার হিসেব নেই। বাইকটা একপাশে রেখে বারো লিটার কোক আর একটা ফুলের তোড়া নিয়ে গেটের ভেতরে ঢুকলাম।

গেটের সিকিউরিটি একটা খাতা এগিয়ে দিল। সেখানে নাম, ঠিকানা, মোবাইল নাম্বার, কোন বাসায় যাব, সেই বাসার বসবাসকারীর সাথে আমার সম্পর্ক কী এসব কিছু লিখলাম। সিকিউরিটি গার্ডদের ভাবসাব দেখে মনে হতে পারে এরা প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে। এদিকে আবার গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে লাল সতর্কতা মানে রেড এলার্ট জারী হওয়াতে বিশেষ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। 

খাতায় নাম-ঠিকানা লেখা শেষ করতেই দুইজন সিকিউরিট গার্ডের একজন জিজ্ঞেস করে, ‘যে বাসায় যাবেন আপনার কী হয়?’ একবার লিখেছি খাতায় তারপর আবার জিজ্ঞেস করাতে আমার  ঘাড়ের রগটা কেমন একটু চাড়া দিয়ে উঠল। নিন্দুকেরা বলে আমার ঘাড়ের একটা রগ নাকি আজন্ম ট্যারা। অনেক কষ্টে নিজেকে সামাল দিলাম। কোনো রকম দৃশ্য সৃষ্টি না করে চেপে যেতে সক্ষম হলাম। শান্তভাবে বললাম -‘বন্ধু’। 

গার্ডদের অন্যজন তখন বলে, ‘যান উপরে চলে যান। স্যারের তো আজ জন্মদিন। যান লিফটের পাঁচ।’ 

সিকিউরিট গার্ডের খাতায়ও বন্ধুই লিখেছি। আসলে ওনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ডিপার্টমেন্টেই দুই বছরের সিনিয়র ছিলেন। এখন ব্যাংকার। লেখালেখি করেন। তিন চারটা উপন্যাসও বের হয়েছে এপর্যন্ত। তবে ফেসবুক আর ব্লগে লেখালেখি করেই তিনি মোটামুটি সেলিব্রেটি হয়ে উঠেছেন। আমার সাথে ওঁর বন্ধুত্বটা বেশ ভালই বলা যায়। তবে আজ আমি তাঁর কাছে সেই বন্ধুত্বের পরিচয়ে আসি নি। গার্লফ্রেন্ড পাঠাল তাই আজ এলাম বা আসতে বাধ্য হলাম।

আমার সহপাঠি এবং গার্লফ্রেন্ড  শাহিনা এই লেখকের ভক্ত। যেমন তেমন ভক্ত না, কঠিন ভক্ত। যাকে বলে অন্ধ ভক্ত। ওনি সব সময় কোক খেতে অনেক পছন্দ করেন তাই শাহিনা আমাকে দিয়ে তার প্রিয় লেখকের জন্য বারো লিটার কোক আর একটা ফুলের তোড়া পাঠিয়েছে জন্মদিনের উপহার হিসেবে। পাঁচ শ’ মি. লি. কোক এর চব্বিশটি বোতল এক সাথে প্লাস্টিকের মোড়কে আটকানো থাকে। এটাকে বলে এক কেস। এ রকমই এক কেস কোক আর একটা ফুলের তোড়া নিয়ে আমি উঠলাম সেই লেখকের বাসায়।

শাহিনাকে দেখে দেখে এখন আমার মনে হচ্ছে মেয়েরা এখনও রবি ঠাকুর আর কাজী নজরুলের যুগের মেয়েদের মতোই কবি লেখকদের ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী থাকে, এমনকি প্রেমেও পড়ে ঠুসঠাস। প্রিয় কবি কিংবা লেখকটি দেখতে কেমন, তাঁর স্বভাব কেমন, মাথাভর্তি চুল নাকি স্টেডিয়াম, তাঁর বউ দেখতে কেমন এনিয়ে তাদের আগ্রহের কমতি নেই। প্রিয় সেই কবি যা বলে কিংবা লেখে তাই তার ভাল লাগে। একবার যদি সেই কবি বা লেখকটির সাথে একটু সম্পর্ক করতে পারে তো কবি বা লেখকটি যা-ই লিখেন তার মনে হয় তাকে ভেবেই লিখেছেন। 

আমাদের এই লেখকের নাম শিপলু। ভাল নাম কিছু একটা আছে কি না জানি না, ওনি এখন শিপলু নামেই লেখেন এবং এই নামেই পরিচিত। এমনিতে শিপলু ভাই অনেক ভাল মানুষ। কিন্তু তাঁর সাথে শাহিনার অতিরিক্ত আহ্লাদিপনার কারণে ইদানীং এই লোকটাকে আমার দেখতে ইচ্ছে করে না। আমি কেমন হিংসে করতে শুরু করেছি তাঁকে। মাঝে মাঝে তো আমার মন সন্দেহপ্রবনও হয়ে উঠে।  

এক দিন জিজ্ঞেসই করে বসলাম, ‘আচ্ছা সত্যি করে বলতো আসলে তোমার মনের গহীনে কে বাস করে; আমি নাকি অন্য কেউ?’

আমার কথা শুনে শাহিনা কিছুক্ষণ আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইল যেন আমার এই সহজ কথাটি সে বুঝতে পারছে না। তারপর হেসে দিল ফিক করে। হাসতে হাসতে বলল-‘বিয়ের আগেই সন্দেহ করতে শুরু করেছ। বিয়ের পর না জানি কী আছে কপালে! 

“তোমার ঘরে বাস করে কারা ও মন জান না!
তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা, 
এক জনে সুর তুলে একতারে, ওরে মন,
আর একজনে মন্দিরাতে তাল তুলে
ও আবার বেসুরে সুর ধরে দেখ কোনজনা  .....”

মাথা নিচু করে গুনগুনিয়ে একটুক্ষণ গান গাইল শাহিনা। তারপর বলল, তুমি জানতে চাচ্ছো আমার মনের গহীনে কে বাস করে। মনের গহীনে তো কত জনই বাস করে। একেক জন একেকভাবে বাস করে আরকি। তুমি সেসব বুঝবা না। আচ্ছা তুমি কি দ্রৌপদীর গল্পটা জান? 

দ্রৌপদীর ছিল পাঁচ স্বামী। 

দ্রৌপদী আবার কে?

দ্রৌপদী হলেন মহাভারতের কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র। ইনি ছিলেন পঞ্চপান্ডবের সহধর্মিনী। অর্থাৎ তিনি এক নারী পাঁচ পাঁচ জন পুরুষের স্ত্রী ছিলেন। পঞ্চপান্ডব হলেন, যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব। মহাভারতের এই পাঁচ চরিত্র, পাঁচ ভাইয়ের স্ত্রী ছিলেন একা এক দ্রৌপদী। 

কি ভয় পেয়ে গেলে নাকি?  ভয় পেয়ো না, আধুনিক দ্রৌপদী হওয়ার কোনো আকাঙ্ক্ষা আমার নেই। এমনিই তোমার কথায় কেন জানি দ্রৌপদীর কথা মনে পড়ে গেল।

হাসতে হাসতে কথাগুলি বলে শাহিনা। তারপর বলে, হিংসে করা ছাড়ো মিঞা! আমি একটা লেখাপড়া করা মেয়ে, একজন মানুষ, আলাদা একটা ব্যাক্তি। পৃথিবীর আর সব মানুষের মতো আমারও একটা জগত আছে, পছন্দ অপছন্দ, পেশা আছে, ভাল লাগা মন্দ লাগা আছে, নাকি? পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই আলাদা আলাদা সত্তা।  তাই সম্পর্কের মাঝখানে একটা স্পেস তো রাখতেই হবে। এই স্পেসটা কিন্তু সম্পর্ককে তাজা রাখতে সহায়ক।তোমার যেমন নানান জায়গায় কাজ থাকে আমারও তো সে রকমই নানান জায়গায় কাজ থাকতে পারে। কাজের জন্যেই আমাকেও তো নানান মানুষের সাথে মিশতে হবে। নানান কাজ করতে গিয়ে কতো রকম মানুষের সাথে পরিচয় হয়। এখন আমি কি বলব যে, আমি কারো সাথে কথা বলতে পারব না। কারণ আমার বয়ফ্রেন্ড বা হাজবেন্ড আছে? 

বেশ বিজ্ঞের মতো কথাগুলি বলছিল শাহিনা। এমনভাবে কথাগুলি বলছিল যে, আমি বেশ মজাই পাচ্ছিলাম। আমি চেয়ে রইলাম তার মুখের দিকে। তার হাব-ভাব আর মুখের ভঙ্গি দেখে আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। মুগ্ধ হয়ে মজে রইলাম এক তরুণীর রূপে, এক নারীর রূপে। বললাম থামো, থামো। তোমার এক্সপ্রেসানগুলি আমাকে কাবু করে ফেলে। তারচেয়ে ভাল একটা কবিতা শোন,

“পাগলী, তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোবালি কাটাব জীবন
এর চোখে ধাঁধা করব, ওর জল করে দেব কাদা
পাগলী, তোমার সঙ্গে ঢেউ খেলতে যাব দু’কদম।
সন্ধেবেলা ঝগড়া হবে, হবে দুই বিছানা আলাদা
হপ্তা হপ্তা কথা বন্ধ মধ্যরাতে আচমকা মিলন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ব্রক্ষ¥চারী জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে আদম ইভ কাটাব জীবন”

‘এই কবিতা তুমি লিখছো?’

'আরে না, এটা ‘জয় গোস্বামী’র লেখা কবিতা। ‘পাগলি তোমার সঙ্গে ......’। বিরাট কবিতা। মাঝখান থেকে যতটুকু মনে পড়ল ততটুকু পড়লাম।’ 

‘ও আচ্ছা, তুমি তো আবার কবিতা টবিতা লিখ তাই বললাম আর কি।’

‘আরে না, আমি কি আর শিপলু ভাইয়ের মতো বড় লেখক নাকি? আমি লেখব এই কবিতা!’

‘শোন, শিপলু ভাই কবিতা লেখেন না, ওনি গল্প-উপন্যাস লেখেন। আর শোন! আবারও কিন্তু তোমার কথায় হিংসার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আবারও বলি, এরকম হিংসা করার স্বভাব ছাড়ো।’ 

তো এই শিপলু ভাইয়ের জন্মদিনের উপহার পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব পড়ল আমার ঘাড়ে। কী আর করা! প্রেমিকার আদেশ বলে কথা! প্রেমিকা তার প্রিয় লেখককে উপহার পাঠাবে আমি কী করে তা পৌঁছে না দিয়ে থাকতে পারি! 

এখনও মনে হয় মেহমানরা এসে পৌঁছান নি। আমি এমনটাই চেয়েছিলাম। অনুষ্ঠান শুরুর আগেভাগেই উপহার পৌঁছে দিয়ে কোনো একটা অজুহাত দেখিয়ে বিদেয় হব এমনটাই আমার ইচ্ছে।

বসার ঘরটা বেশ বড়। শিপলু ভাই ছাড়া দেখলাম এক জন বয়স্ক ভদ্রলোক এক কোণে বসে কোনো একটা ম্যাগাজিনে চোখ বুলাচ্ছেন। জিজ্ঞেস করতে শিপলু ভাই বললেন, আমার মামা। এগিয়ে গিয়ে মামার সাথে হাত মিলালাম। কিন্তু এই হাত মিলানোটাই আমার জন্য কাল হল। হাত মিলাতেই মামা আমাকে পেয়ে বসলেন। তার সাথে আমার কথোপকথন ছিল এরকম:

কী নাম তোমার, বাবা?

আরণ্য। নিনাদ আরণ্য।  

অরণ্য মানে কী! এটা কেমন নাম হল। একটা ছেলের নাম কেন বন-জঙ্গল হবে! 

অরণ্য না মামা, আরণ্য। 

ঐ তো অরণ্য আর আরণ্য, পার্থক্য কী?

আমি কিছু ব্যাখ্যা ট্যাখ্যা দিতে যাচ্ছিলাম আর কি। কিন্তু শিপলু ভাই ইশারা করলেন, যার অর্থ চুপ থাকো। আমি একটা প্রশস্ত হাসি দিয়ে চুপ করে রইলাম। ভদ্রলোকও চুপ করলেন। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। তবে আমি সবচেয়ে বড় হাঁপটা ছাড়লাম তখন যখন শাড়ি পরে সেজেগুজে এক তরুণী বসার ঘরে ঢুকলেন এবং শিপলু ভাই আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, এ হচ্ছে লুবনা, তোমাদের ভাবী। আমার একমাত্র বউ।


  • Loging for Like
  • মোট পছন্দ করেছেন 0 জন
  • মন্তব্য 0 টি
  • গল্প


  • অাট কুঠুরি নয় দরজা
  • ট্রাফিক পুলিশ এবং বউ বনাম গাড়ি
  • এভাবেই হয়
  • অনির্বচনীয় অনুভূতি ........ গল্প
  • গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ ১৪৫৩ বঙ্গাব্দ
  • খন্দকার অাবদুল মজিদ ও তাঁর রহস্যময় রাত

অাট কুঠুরি নয় দরজা

উত্তরা এগারো নম্বর সেক্টরের চার নম্বর রোডের তেতাল্লিশ নম্বর বাসা। বাসা খুঁজে পেতে আমাকে বিশেষ বেগ পেতে হল না। আমি ঢাকার দক্ষিণ প্রান্তের মানুষ হলেও এই এলাকায় আমার অনেক আত্মীয়-স্বজন-মামা-

ট্রাফিক পুলিশ এবং বউ বনাম গাড়ি

উত্তরা এগারো নম্বর সেক্টরের চার নম্বর রোডের তেতাল্লিশ নম্বর বাসা। বাসা খুঁজে পেতে আমাকে বিশেষ বেগ পেতে হল না। আমি ঢাকার দক্ষিণ প্রান্তের মানুষ হলেও এই এলাকায় আমার অনেক আত্মীয়-স্বজন-মামা-

এভাবেই হয়

উত্তরা এগারো নম্বর সেক্টরের চার নম্বর রোডের তেতাল্লিশ নম্বর বাসা। বাসা খুঁজে পেতে আমাকে বিশেষ বেগ পেতে হল না। আমি ঢাকার দক্ষিণ প্রান্তের মানুষ হলেও এই এলাকায় আমার অনেক আত্মীয়-স্বজন-মামা-

অনির্বচনীয় অনুভূতি ........ গল্প

উত্তরা এগারো নম্বর সেক্টরের চার নম্বর রোডের তেতাল্লিশ নম্বর বাসা। বাসা খুঁজে পেতে আমাকে বিশেষ বেগ পেতে হল না। আমি ঢাকার দক্ষিণ প্রান্তের মানুষ হলেও এই এলাকায় আমার অনেক আত্মীয়-স্বজন-মামা-

গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ ১৪৫৩ বঙ্গাব্দ

উত্তরা এগারো নম্বর সেক্টরের চার নম্বর রোডের তেতাল্লিশ নম্বর বাসা। বাসা খুঁজে পেতে আমাকে বিশেষ বেগ পেতে হল না। আমি ঢাকার দক্ষিণ প্রান্তের মানুষ হলেও এই এলাকায় আমার অনেক আত্মীয়-স্বজন-মামা-

খন্দকার অাবদুল মজিদ ও তাঁর রহস্যময় রাত

উত্তরা এগারো নম্বর সেক্টরের চার নম্বর রোডের তেতাল্লিশ নম্বর বাসা। বাসা খুঁজে পেতে আমাকে বিশেষ বেগ পেতে হল না। আমি ঢাকার দক্ষিণ প্রান্তের মানুষ হলেও এই এলাকায় আমার অনেক আত্মীয়-স্বজন-মামা-






চয়নিকা মননশীল সাহিত্যচর্চার একটি উন্মুক্ত ক্ষেত্র। এখানে প্রদত্ত প্রতিটি লেখার দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণ লেখকের নিজের।
Choyonika.com