বাঙালী, বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কেমন ছিল তাঁর লেখালেখি জীবনের শুরুটা? তাঁর নিজের লেখায় নিজের বিশ্লেষণেই আমরা জেনে নেই:
”আমি যখন কবিতা লিখতে শুরু করি তখন আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায়ভুক্ত লোকেরা ইংরেজী পাঠ্যবই থেকে দিকনির্দেশনা নিতেন। এসব বই উপর থেকে কিছু পাঠ ঢেলে দিত, কিন্তু তাতে মনের খোরাক মিলত না। আমার ধারণা, এটা আমার সৌভাগ্র যে, জীবনে আমার এমন শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল না যা কোনো সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানের জন্য সঙ্গত মনে করা হত। যদিও আমি অস্বীকার করব না যে, তখনকার সময়ে তরুন সমাজে চিন্তা-ভাবনার যে প্রবনতা বিরাজিত ছিল তা থেকে আমিও সম্পূর্ণভাবেমুক্ত ছিলাম না। তারপরও আমি বলব, আমার লেখার ধারা অনুকরণমূলক আঙ্গিকগুলো থেকে সুরক্ষিত ছিল। আমার কাব্যে, চিন্তা-দর্শনে আমি এক অশিক্ষিত কল্পনার খোশখেয়ালের কাছে সমর্পিত ছিলাম, যা আমার জন্য বয়ে এনেছিল পন্ডিত সমালোচকদের ধিক্কার আর চতুর লোকদের সশব্দ হাসি। আমার অজ্ঞতা আর প্রথা- বিরুদ্ধ বিশ্বাসের দ্বৈরথ তাদের কাছে আমাকে পরিণত করে এক সাহিত্য-বখাটে হিসেবে।
যখন লিখতে শুরু করি তখন আমি হাস্যকর রকমের তরুণ। যারা সেসময় নিজেদের সবাক করে তুলেছিল তাদের দলে আমি কনিষ্ঠতম। আমার না ছিল পরিণত বয়সের রক্ষাকবচ আর না ছিল সম্মানজনক ইংরেজী জ্ঞান। সুতরাং আমার জন্য বরাদ্দ ছিল ঘৃণার গন্ডি। কিছু শর্ত্ যুক্ত (সফটওয়্যারের সমস্যায় শব্দটি মিলিয়ে লিখতে পারছি না) উৎসাহেই ছিল আমার স্বাধীনতা। ধীরে ধীরে আমি কেবল বয়সেই বেড়ে উঠলাম, কোনো কৃতিত্বের দাবীদার হতে পারলাম না। তবে এক সময় ধীরস্থিরভাবে, উপহাস আর সাময়িক পোষকতার ভেতর দিয়ে, পথ কেটে কেটে একটি এমন স্বীকৃতির স্থানে আমি পৌঁছলাম যেখানে প্রসংশা আর দোষারোপের অনুপাত ঠিক পৃথিবীর বুকে স্থল আর জলভাগের অণুপাতের অনুরূপ।
বাংলার বৈষ্ণব কবিতার সাথে আমার একটু আগেভাগেই পরিচয় ঘটে যাওয়াটা তরুণ বয়সে আমাকে অনেক সাহস যুগিয়েছিল। এসব কবিতা স্বাধীন আর সাহসী প্রকাশে পূর্ণ্ ছিল। আমার যতটুকু মনে পড়ে আমার বয়স যখন বারো তখন এই কবিতাগুলো প্রথম পুনর্মুদ্রিত হতে শুরু করে। বড়দের ডেস্ক থেকে গোপনে আমি এগুলোর নমুনা পেতে শুরু করি।
তরুণদের শিক্ষার জন্য আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, আমার বয়সী একটি বালকের জন্য এটা সঙ্গত ছিল না। আমার তখন উচিৎ ছিল পরীক্ষাগুলোতে পাশ করা, নম্বর হারানোর রাস্তায় না হাঁটা। আরও স্বীকার করা উচিৎ যে, এসব নীতিকবিতার অধিকাংশই ছিল বড়দের জন্য এবং সদ্য কৈশোর পেরুনো বালকের জন্য অনুপযোগী। কিন্তু এগুলোর আঙ্গিকের নান্দনিকতায় এবং শব্দের ঝংকারে আমার চেতনা তখন সম্পূর্ণ্ সম্মোহিত। আর ইন্দ্রিয়পরায়নতায় এগুলোর প্রাণ এতটাই পূর্ণ্ হয়ে থাকত যে, সেগুলোর অনুগামী না হয়েও আমার প্রাণ জুড়িয়ে যেত।”
(রাধাকৃষ্ণান সম্পাদিত Contemporary Indian Philosophy সংকলনে রবীন্দ্রনাথ রচিত The Religion of an Artist প্রবন্ধ থেকে অনূদিত)