জ্বী বলুন! জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম আগন্তুকের দিকে। ডক্টরস কেন্টিনে বসে চা খাচ্ছিলাম। এমন সময় এক ভদ্রলোক সামনে কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছিলেন।
‘ডক্টর মারুফ হাসান কল্লোল?’- নিশ্চিত হতে চাচ্ছেন ভদ্রলোক।
'হ্যাঁ, বলুন কী করতে পারি আপনার জন্য!'
আমি ছাইফুল ইসলাম। আপনিই মনে হয় আমার মা’র চিকিৎসার দেখাশোনা করতেন বৃদ্ধাশ্রমে। তার ডেথ সার্টিফিকেটও আপনিই দিয়েছেন বলে শুনেছি। মানে গত মাসে আপনাদের বৃদ্ধাশ্রমে যে মহিলাটি মারা গেছেন, আফরোজা বেগম, তাঁর পেটেধরা একমাত্র সন্তান আমি। হতভাগা আমি এতদিনে এলাম মাকে দেখতে। কিন্তু আমার ভাগ্যে নেই। শেষ দেখাটাও দেখতে পারলাম না।
বুঝতে পারলাম এই ভদ্রলোকই আফরোজা খালার ছেলে। হ্যাঁ, তাঁকে আমি আফরোজা খালা বলেই ডাকতাম। প্রথম সাক্ষাতেই ভদ্রমহিলা আমাকে বেশ আপন করে নিয়েছিলেন। তাঁর আচার-আচরণে কেমন একটা মা মা ভাব থাকত। চলনে-বলনে,অবয়বে এবং শারীরিক ভাষা ও দেহভঙ্গির প্রকাশে এক ধরনের বনেদিপণা ছিল যদিও তিনি সাধারণ নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিলেন।
আমি তাঁকে শেষ দু’ বছর পেয়েছি এখানে। তিনি নিজেই তাঁদের পারিবারিক নানান গল্প করতেন আমার সাথে। কিন্তু এই দু’বছরে নিজের ছেলে সম্পর্কে কোনোকিছুই বলেন নি আমাকে। ছয় বছর বৃদ্ধাশ্রমবাসের পর গত মাসে মানে আজ থেকে একমাস নয় দিন আগে তিনি মারা গেছেন। আর মাকে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে পালিয়ে যাওয়া এই ছেলে মার খবর নিতে যখন এসেছে তখন মা আর জীবিত নেই। মা মারা যাওয়ার এক মাস নয় দিন পর ছেলে মাকে দেখতে এসেছেন। যাইহোক, ভদ্রলোককে সামনের চেয়ারে বসতে বললাম; বসলেন। চা অফার করলাম; রাজি হলেন।
সামনের চেয়ারে বসে ভদ্রলোক কাঁদতে শুরু করলেন। ইচ্ছে করছিল কঠিন কিছু কথা শুনিয়ে দেই। কিন্তু সংবরণ করলাম নিজেকে। তাকে কিছু বলার আর দরকার নেই। যে ধন তিনি হেলায় হারিয়েছেন এখন তিনি কাঁদবেন সারা জীবনই। তাতে তার নিজের তো কোনো উপকার হবে না, তাকে দেখে যদি আশপাশের মানুষরা কিছু শেখে!
বৃদ্ধাশ্রমটির সাথে আমার যোগাযোগটা হয় হঠাৎই । এখানকার জেলা সদর হাসাপাতালে পোস্টিং হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই একজন সিনিয়র কলিগের মাধ্যমে স্থানীয় একটি বৃদ্ধাশ্রমের পক্ষ থেকে আমাকে প্রস্তাব দেওয়া হয় তাদের কনসালট্যান্ট হতে। অবৈতনিক। সপ্তাহে দুবার গিয়ে সেখানকার অধিবাসীদের শরীর স্বাস্থের অবস্থাটা দেখে আসতে হবে। আমি রাজি হয়ে যাই।
জেলা শহরের কাছেই সেই বৃদ্ধাশ্রম। অন্য অনেক মা-বাবার সাথে এখানে বাস করছেন আফরোজা বেগম। একজন মা যিনি প্রতিটা দিন তাঁর প্রতারক ছেলেটার জন্য অপেক্ষা করে করে আছেন। অপেক্ষা করেছেন জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত। কারণ যাওয়ার আগে ছেলে বলে গিয়েছিল একটু পরেই এসে তাঁকে নিয়ে যাবে। কিন্তু ছয় বছর ধরে সে এখানে জীবিত ছিল কিন্তু ছেলে আসে নি।
ছাইফুল ইসলামের বাবা মারা গিয়েছিল তার এস এস সি পরীক্ষার পর পরই। তারপর ছেলের পড়াশোনার জন্য এই মাকে অনেক কষ্ট করতে হলেও দমে যান নি তিনি।
মানুষের মত মানুষ করার জন্য তিনি ছাইফুল ইসলামকে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করাতে চান। তাঁর সেই ইচ্ছা পূরণও হয়। ওখান থেকে অনার্স মাষ্টার্স করার পর ছেলেকে বিয়ে করান ছেলের নিজের পছন্দ করা মেয়েকে। এক সময় ছেলে আর ছেলের বউ দু’জনের চাকরীও হয়ে যায় ঢাকাতে। ঢাকাতেই ফ্ল্যাট ভাড়া করে ছেলে তার বউসহ সংসার শুরু করে।
তখনই আফরোজা বেগমের সাধ জাগে ছেলের বাসায় গিয়ে ছেলের সংসারে ছেলের সাথে থাকবেন। সেটা সরাসরি ছেলেকে না বললেও তাঁর যে এখানে বাড়িতে একা একা ভাল লাগে না সেটা ফোনে সুযোগ পেলেই বলেন। ছেলে চাকরী করে ঢাকায়। সেতো আর গ্রামে এসে থাকতে পারবে না, তাই তিনিই ঢাকা চলে যাবেন বলে মনে মনে ভেবে রাখেন।
এরই মধ্যে ছাইফুল ইসলাম বউসহ বাড়ি যায় দুই দিনের জন্য। দ্বিতীয় দিন সকালের দিকে মাকে বলে, বাসায় তারমন একদমই টিকছে না। জেলা শহরে যাবে ঘুরতে। মাকে বলল ‘তুমিও চলো আমাদের সাথে’। তিনিও রাজি হলেন। বাসে উঠে জেলা শহরে পথে চলল তারা তিন জন। শহরে পৌঁছতেই ছাইফুল ইসলাম মাকে বলল, মা! এখানে একটি বৃদ্ধাশ্রম আছে। আমরা আগে সেইখানটা ঘুরে আসি। বৃদ্ধাশ্রমে পৌঁছে ছাইফুল মাকে বলে, মা! তুমি একটু এখানে অপেক্ষা করো আমি তোমার বউমাকে নিয়ে একটু বাইরে যাচ্ছি। একটু পরেই চলে আসবো। মা তো আর জানেন না ছেলের মনের খবর। তিনি ছেলেকে বলে দিলেন ‘তারাতারি চলে আসিস বাবা’।
সেদিন দুপুর থেকে বিকেল হল, বিকেল থেকে সন্ধ্যা হল, তারপর সন্ধ্যা থেকে হল রাত। কিন্তু ছাইফুল ইসলাম আর ফিরে এলো না। বৃদ্ধাশ্রমের অফিস থেকে মাকে বলা হল, ছাইফুল ইসলাম তাকে এখানে এন্ট্রি করে ঢাকা চলে গেছে।
রাতে অফিসের লোকজন তাঁকে একটা রুমে নিয়ে বলল, আজ থেকে আপনি এখানেই থাকবেন। তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। সারা রাত ঘুমাতে পারেন নি। কেঁদেছেন সারা রাত অবিরাম। ফজরের আজান হলে নামাজ ঘরে গিয়ে নামাজ পড়ে দু’হাত তুলে মোনাজাত করেন সৃষ্টিকর্তার কাছে। না, তিনি সন্তানকে অভিশাপ দেন না; বরং সৃষ্টিকর্তাকে বলেন তিনি যেন তার সন্তানকে ক্ষমা করে দেন। মাকে কষ্ট দেওয়াতে তিনি যেন ছেলের কোনো অমঙ্গল না করেন।
এই হল আফরোজা বেগমের বৃদ্ধাশ্রম বাসের ইতিহাস। না, এই ইতিহাস তিনি নিজে আমাকে বলেন নি। কিছুটা বৃদ্ধাশ্রম কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আর কিছুটা শুনেছি তাঁর সহবোর্ডারদের কাছ থেকে। ছেলে কুকীর্তি আফরোজা বেগম কারও কাছে প্রকাশ করতে চান নি; ছেলের বিরুদ্ধে কখনও কোনো অভিযোগও করতেন নি তিনি। এমনকি মন খারাপও করতেও চান নি; পাছে তাঁর সন্তানের কোনো অমঙ্গল হয়! মায়ের মন বুঝি এমনই হয়!